জ্বালানি জটিলতায় ১০ মাস ধরে বন্ধ পটুয়াখালী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, প্রতিদিন ৫ কোটি টাকা লোকসান

মনোযোগ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৫ এএম

পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কয়লা আমদানির জটিলতার কারণে গত ১০ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শেষ হলেও কয়লা সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ায় উৎপাদন শুরু করা যাচ্ছে না। এর ফলে সরকারকে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশের রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) ও চীনের নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল যৌথভাবে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে। মোট ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পের মধ্যে ১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার এসেছে চীনের ঋণ হিসেবে। ২০১৯ সালের আগস্টে কাজ শুরু হয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে দুটি ইউনিটের নির্মাণ সম্পন্ন হয় এবং এপ্রিল মাসে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করা হয় কেন্দ্রটি। কিন্তু কয়লা না থাকায় উৎপাদন শুরু হয়নি। এরই মধ্যে সরকারকে “ক্যাপাসিটি চার্জ” বাবদ জরিমানা গুনতে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পূর্ববর্তী সরকারের বিদ্যুৎ নীতির ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকারও দেশীয় উৎপাদনের বদলে আমদানি-নির্ভর নীতি বজায় রাখছে। এর ফলে স্থানীয় গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক উৎপাদন কমে যাচ্ছে, অথচ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বাড়ছে। ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ভারতীয় কোম্পানি আদানি পাওয়ার থেকে বিদ্যুৎ আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
কয়লা আমদানিতে অদক্ষতা ও দরপত্র জটিলতা
২০২২ সাল থেকে চারবার দরপত্র আহ্বান করা হলেও এখনো কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করা যায়নি। প্রতিবারই দরপত্রে অংশ নেয় সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইয়াংথাই এনার্জি প্রাইভেট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি অভিযোগ করেছে, সব শর্ত পূরণ করেও তারা কার্যাদেশ না পাওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ইয়াংথাই আরও জানায়, সর্বশেষ দরপত্র বাতিল করা হয় পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই, এবং নতুন দরপত্রে শর্ত শিথিলের প্রস্তাব দেওয়া হয়-যা প্রকৌশলগত ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, নিম্নমানের কয়লা ব্যবহারে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বয়লার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যেতে পারে।
ভারতীয় প্রভাব ও সিন্ডিকেটের অভিযোগ
বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, ভারতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি কোম্পানিকে সুবিধা দিতে দরপত্র প্রক্রিয়া বারবার আটকে দেওয়া হচ্ছে। এর পেছনে পুরোনো সিন্ডিকেটের প্রভাব কাজ করছে, যা সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সময় থেকে বিদ্যুৎ খাত নিয়ন্ত্রণ করে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, “যদি পটুয়াখালী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু করা যেত, তবে আদানির কাছ থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ আমদানির প্রয়োজন হতো না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এখনো সেই সুবিধাভোগী গোষ্ঠী এই খাত নিয়ন্ত্রণ করছে।”
বুয়েটের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, “কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো সচল করা গেলে উচ্চ ব্যয়ের ফার্নেস ওয়েল-নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা সম্ভব হতো। এতে বিপুল অর্থ সাশ্রয় হতো এবং গ্যাস শিল্পে সরবরাহ বাড়ানো যেত।”
তিনি আরও বলেন, “সরকারকে এখন আমদানি-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে দেশীয় কয়লাভিত্তিক উৎপাদনে জোর দিতে হবে। তা না হলে জ্বালানি সংকট ও অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়তেই থাকবে।”